রনি আহম্মেদ
মাত্র ১০ মিনিটের অপারেশন। ফিল্মি স্টাইলে পোশাক শ্রমিকদের বেতনের ৮০ লাখ টাকা লুটে নেয় ডাকাত দল। এর জন্য তারা পরিকল্পনার ছক আঁকে প্রায় পাঁচ মাস। কর্মীবেশে প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি করতো ডাকাত দলেরই সদস্য। তার মাধ্যমে পাচার হতো যাবতীয় তথ্য।
গত ৭ জুন গাজীপুরের কালিয়াকৈর সুরিচালা এলাকার ইনক্রেডিবল ফ্যাশনস্ লিমিটেড গার্মেন্টসেরর মাইক্রোবাস থেকে ৮০ লাখ ২২ হাজার টাকা লুট করে নেয় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় রবিবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারীসহ পাঁচজনকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নগদ ৩০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, এক হাজার ১০০ ইউএস ডলার, একটি প্রাইভেট কার, তিনটি মোটরসাইকেল, একটি বিদেশি রিভলবার, একটি বিদেশি পিস্তল, ২১ রাউন্ড গোলাবারুদ, দুটি ম্যাগজিন, তিনটি পাসপোর্ট এবং ৩৮টি মোবাইল ফোন। আটকৃতরা হলেন- রিয়াজ, সাগর মাহমুদ, জলিল, ইসমাইল হোসেন মামুন ও মনোরঞ্জন মন্ডল বাবু।
বিকালে অনলাইন ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম।
র্যাব জানায়, প্রায় ৪/৫ মাস আগে চক্রটির মূলহোতা জলিলের পরিকল্পনায় ঈসমাইল হোসেন এবং মনোরঞ্জন মন্ডল দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ শেষে টার্গেট নির্ধারণ করেন। কারণ, ইনক্রেডিবল গার্মেন্টসের শ্রমিকদের বেতন ক্যাশে প্রদান করা হয় এবং ব্যাংক থেকে টাকা সংগ্রহের সময় কোনো অস্ত্রধারী নিরাপত্তা প্রহরী থাকে না। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোরঞ্জন ওই গার্মেন্টসে সাব-কন্টাক্ট হিসেবে মার্চ থেকে আসা যাওয়া শুরু করে। এরপর গার্মেন্টসের অন্যান্য কর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী, পার্শ্ববর্তী দোকান ও অন্যান্য জায়গা থেকে কৌশলে তথ্য সংগ্রহ করে। তার তথ্যের ভিত্তিতেই ডাকাতির পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গত এপ্রিল-মে মাসে ডাকাতির পরিকল্পনা করলেও তা ভেস্তে যায়। কারণ এপ্রিলের বেতন দেয়া হয়েছিল মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এবং মে মাসের বেতনের টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল পুলিশ স্কটের মাধ্যমে। তবে জুন মাসের বেতন পুলিশ স্কট থাকবে না নিশ্চিত হয়ে ৭ জুন ডাকাতির দিন নিদ্ধারণ করে। ঘটনার ১২-১৫ দিন আগে ঈসমাইল, জলিল এবং মনোরঞ্জন মাঠ পর্যায়ে রেকি করে ডাকাতির জন্য সুবিধাজনক স্থান নির্বাচন করেন।
সারওয়ার আরও বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন প্রথমে তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন একটি সুবিধাজনক জায়গায় মিলিত হয়। পেছনের আরোহীদের সবাই অস্ত্র বহন করেছিল। অন্যদিকে ছিনতাইয়ের টাকা বহনের জন্য একটি প্রাইভেটকার জামগড়া নামক স্থানে অপেক্ষা করছিল। আর মনোরঞ্জন গার্মেন্টস এলাকা থেকে ডাকাতদলটিকে প্রতি মুহূর্তের তথ্য সরবরাহ করছিলেন। সাড়ে ১১টার দিকে মোবাইলে মূলহোতা জলিলকে টাকা উত্তোলনের জন্য গার্মেন্টসের লোকজন মাইক্রোবাসে ব্যাংকের উদ্দেশে যাত্রা করেছে বলে জানান মনোরঞ্জন। তথ্যের ভিত্তিতে সফিপুরে অপেক্ষমাণ তিনটি মোটরসাইকেল নিরাপদ দূরে থেকে মাইক্রোবাসটি অনুসরণ করতে থাকে। টাকা উত্তোলনের পর ফেরার পথে খাড়াজোড়া এলাকায় দুটি মোটরসাইকেল মাইক্রোবাসের সামনে গিয়ে মাইক্রোবাসের গতি কমিয়ে দেয়। তৃতীয় মোটরসাইকেলটি মাইক্রোবাস থামিয়ে দিয়ে কৌশলে ব্যারিকেড দিয়ে ফেলে।
এরপর ডাকাত দলের সদস্যরা লোহার হ্যামার দিয়ে মাইক্রোবাসের গ্লাস ভেঙে ফেলে এবং অতর্কিতভাবে মাইক্রোবাসের সামনের গ্লাসে গুলি ছোঁড়ে। এতে একটি গুলি ফ্যাক্টরির সহকারী মার্চেন্ডার রাজীব মজুমদার গুরুতর জখম হন। পরবর্তী সময়ে তারা মাইক্রোবাসে থাকা ফ্যাক্টরির লোকদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে জোরপূর্বক টাকা ছিনিয়ে নিয়ে মাত্র ৫-১০ মিনিটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। ঘটনাস্থলে এলোপাথারি গোলাগুলির ফলে দলের মূল হোতা জলিলের হাতেও গুলিবিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তারা মোটর সাইকেলযোগে জামগড়া কাশিমপুর রোডে অপেক্ষায় থাকা প্রাইভেট কারের কাছে পৌঁছান। গুলিবিদ্ধ জলিল এবং লুটকৃত টাকা নিয়ে সাগর ও রিয়াজ ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন।
লে. কর্নেল সারওয়ার বলেন, তারা প্রথমে সাগরের খিলগাঁওয়ের বাসায় যান। সেখান থেকে জলিলকে মালিবাগের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আর পথিমধ্যে টাকাগুলো ভাগ করে নেন। অপারেশনে অংশগ্রহণ ভেদে সবাইকে আট লাখ ২০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা এবং অস্ত্রবহন ও গুলি এবং প্রাইভেট কার প্রদান করার জন্য আলাদা আলাদাভাবে টাকা দেয়া হয়। মূলত ৮-১০ জনের একটি সিন্ডিকেটে এই ডাকাতির ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।